মামুন আবদুল মান্নান। ময়মনসিংহের নান্দাইলের উত্তর বানাইল গ্রামের এই যুবক জীবিকার তাগিদে পাড়ি দিয়েছিলেন মালয়েশিয়ায়। সামান্য বেতনের চাকরি দিয়ে শুরু করেছিলেন পেশা জীবন। এরপর সময়ের ব্যবধানে মালয়েশিয়ায় নিজেই গড়ে তোলেন একের পর এক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।
কুয়ালালামপুর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে সেলাঙ্গর প্রদেশের কুনদাং এলাকায় কয়েক একর জমির ওপর ২০১১ সালে গড়ে তোলেন এক বিশাল গরুর খামার। ওই খামারের নাম ‘এম এম ফার্ম’। শুধু গরুর খামারই নয়, সেখানে ছাগল, হাঁস, মুরগি ও মাছ চাষও করেন তিনি।
রাজধানীতে প্রায় ৭০ ভাগ গরুর মাংস তিনিই সরবরাহ করেন। রাজধানী ছাড়াও সেলাঙ্গর প্রদেশের বিভিন্ন সুপারশপে মামুনের খামারের গরুর মাংস দেখা যায়। দিন দিন তার ব্যবসা উন্নতির দিকেই যাচ্ছে।
মামুনের গরুর খামার সরেজমিনে দেখা গেছে, খামারটির পরিবেশ বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বিজ্ঞানসম্মতভাবে গড়ে তোলা হয়েছে ওই খামার। প্রায় তিন হাজার বিভিন্ন প্রজাতির গরু রয়েছে মামুনের খামারে। এক সারির গরু খড় খাচ্ছে। সেখানে ২০ জন বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করছেন। তারাই মূলত খামারের দেখভাল করেন। পাশেই একটি খামারে বিভিন্ন প্রজাতির সহস্রাধিক মহিষ ও ৩ শতাধিক ছাগল দেখা যায়। মুরগি ও হাঁসের খামারও চোখে পড়ে। খামার সংলগ্ন বিশাল একটি পুকুরে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করছেন মামুন। মালয়েশিয়ার বুকে বাংলাদেশের একটি গ্রামীণ পরিবেশ লক্ষ্য করা যায়।
খামারে কর্মরত শ্রমিকরা জানান, এখানে গরু হাতে জবাই করা হয় না। সবই হয় মেশিনের সাহায্যে। এখানে বিভিন্ন হোটেলের প্রতিনিধি বা সুপারশপের লোকজন এসে মাংস নিয়ে যান। কেউ না এলে তারাও ডেলিভারি দিয়ে আসেন। প্রতি কেজি গরুর মাংস ২৬ রিঙ্গিত বাংলাদেশি টাকায় ৫৪৬ টাকায় বিক্রি হয়। গাভি পালন করা হয় শুধু বাচ্চা প্রসবের জন্য। ষাঁড়ের আলাদাভাবে যত্ন নেওয়া হয়। কোরবানির ঈদের জন্যও কিছু ষাঁড় রাখা হয়। তাদের দুই বেলাই খামারে খাবার দেওয়া হয়। এর মধ্যে সকালে দেওয়া হয় প্যাকেটের খাবার, বিকেলে তাদের খড় খাওয়ানো হয়। আর গাভি গরুগুলোকে সকালে নিয়ে যাওয়া হয় পাশেই পামঅয়েলে। বিকালে শুধু খড় খেতে দেওয়া হয়।
জানা গেছে, প্রতি মাসে অন্তত ৩০০ গরু জবাই দেওয়া হয় এম এম ফার্মে। এসব মাংস তারা বিক্রি করেন বিভিন্ন সুপারশপ ও হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোতে। কিছু দিন পরপরই পানিপথে জাহাজভর্তি গরু আনা হয় অস্ট্রেলিয়া থেকে। প্রতি জাহাজে দুই থেকে আড়াই হাজার করে গরু আনা হয়। গরুর মাংসের চাহিদা থাকায় আগামী দিনে প্রতি ট্রিপে দুই জাহাজ আমদানি করার পরিকল্পনাও রয়েছে মামুন বিন আবদুল মান্নানের।
তিনি বলেন, প্রথমে ছোট্ট পরিসরে তিনি ব্যবসা শুরু করেন। এরপর দিন দিন ব্যবসার পরিধি বাড়ানো হয়। সামনে খামার নিয়ে তার বড় ধরনের পরিকল্পনার কথা জানান। প্রায় দুই যুগ ধরে তিনি মালয়েশিয়ায় বসবাস করছেন। নানা তিক্ত অভিজ্ঞতাও তার রয়েছে। তবে এখন তিনি সুখী। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশির সংখ্যা অনেক বেশি। প্রথমে তাদের চাহিদার জন্যই এ ব্যবসা শুরু করি। এখন মালয়েশিয়ানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মানুষজনও আমার খামারের গরুর মাংস নিচ্ছেন।
আলাপকালে মামুন জানান, তার জন্ম নান্দাইলের উত্তর বানাইল গ্রামে ১৯৭৬ সালে। তবে অভাব-অনটনের মধ্যেই বেড়ে ওঠেন। শিক্ষক পিতা আবদুল মান্নান ছিলেন সন্তানদের পড়াশোনার প্রতি সচেতন। উত্তর বানাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আঠারোবাড়ি উচ্চবিদ্যালয়ে এসএসসি এবং কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন।
এরপর জীবিকার তাগিদে ৯৪ সালে পাড়ি জমান মালয়েশিয়ায়। প্রথমে ৩১২ রিঙ্গিত বেতনে কাজ নেন গ্রেট ওমিট টেকনোলজিতে। যা বেতন পেতেন তা দিয়ে থাকা-খাওয়ায় সব শেষ হয়ে যেত। তাই কিছু দিন পর বাধ্য হয়ে চাকরি ছেড়ে দেন। তার মাথায় ঘুরপাক খায় নিজে কিছু করার। সেই থেকে পরিকল্পনা করেন। এরপর আইডিডি ফোনকলের ব্যবসা শুরু করেন। ওই ব্যবসার পুঁজি ছিল মাত্র ১০ হাজার রিঙ্গিত। একটি দোকান ভাড়া নিয়ে পাঁচটি মোবাইল ফোন দিয়ে আন্তর্জাতিক এই ফোনকলের ব্যবসা শুরু করেন।
তিনি জানান, মিনিটের হিসাবের ওই ব্যবসা কিছু দিনের মধ্যে দাঁড় করিয়ে ফেলেন। মুনাফাও বেশ ভালো হয়। বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া ও পাকিস্তানসহ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের প্রবাসীরা তার প্রতিষ্ঠানে এসে ভিড় করত। ব্যবসার ভালো গুডউইল তৈরি হয়। বেশ কিছু টাকা পুঁজিও হয়ে যায়। কিছু দিন পর ব্যবসার পরিধি বাড়ান। শুরু করেন ‘মিনি মার্কেট’ ব্যবসা।
বাংলাদেশি প্রবাসীদের নিত্যপ্রয়োজনীয় এসব পণ্য তিনি সাপ্লাই দিতেন। এই ব্যবসায় তার আয় দ্বিগুণ হয়ে যায়। ব্যবসার পাশাপাশি মালয়েশিয়ার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। আর ব্যবসা করতে গিয়ে পরিচয় হয় মালয়েশিয়ান তরুণী ব্যবসায়ী মাস পুষ্পাওয়াতি বিনতি হাজি সেলিমের সঙ্গে। অল্পদিনের পরিচয়ে ওই তরুণীর সঙ্গে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। এরপর স্বামী-স্ত্রী মিলে ব্যবসার পরিধি আরও বাড়ান।