রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি লাফঝাঁপ করছে সম্ভবত পশ্চিমারা। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন না থামালে তা গোটা বিশ্বের জন্য কীভাবে বিপদ ডেকে আনবে, তা বোঝাতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও এর ইউরোপীয় মিত্ররা। কিন্তু যুদ্ধ তো বিশ্বে নতুন নয়! যে প্রজন্মের মানুষ ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেনে পশ্চিমা নেতৃত্বে অথবা তাদের সহযোগিতায় বছরের পর বছর ধরে ভয়ংকর আগ্রাসন দেখেছে, তাদের কাছে এটা নতুন কোনো সংকট নয়। বোমার আঘাতে ইউক্রেনের কংকালসার ভবনগুলোর সঙ্গে তারা ফিলিস্তিনের ছবির কোনো পার্থক্য দেখেন না।
তবে পার্থক্য দেখছে পশ্চিমারা। কারণ এখানে মারা যাচ্ছে সাদা চামড়ার মানুষ। এখানে ভুক্তভোগী তথাকথিত ‘সভ্য’ পশ্চিমা একটি জাতি। তাই তাদের অন্তর পুড়ে কয়লা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আফগানিস্তান-ইয়েমেনে যুদ্ধের প্রভাবে না খেয়ে মরতে বসা মানুষদের জন্য তাদের হৃদয় কাঁদে না। স্বঘোষিত ‘শান্তির রক্ষক’ পশ্চিমাদের এই দ্বিচারিতা নিয়ে আগেও কথা হয়েছে, তবে ইউক্রেন যুদ্ধে তা আরও পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। পশ্চিমাদের এই ভণ্ডামি ও তার কারণ নিয়ে সম্প্রতি নিক্কেই এশিয়াতে একটি কলাম লিখেছেন মালয়েশীয় ব্যবসায়ী ও হংকং-ভিত্তিক থিংক ট্যাংক ‘দ্য গ্লোবাল ইনস্টিটিউট ফর টুমরো’র প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রন নাইর। পাঠকদের জন্য লেখাটির সারাংশ তুলে ধরা যায়-
রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটকে পশ্চিমা ভাষ্যকাররা খুব দ্রুততার সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যেখানে নতুন বৈশ্বিক ব্যবস্থা আসতে চলেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এটি বোঝানো হচ্ছে মূলত দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে। প্রথমত, বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থা চরম সংকটে পড়েছে, যার একপাশে রয়েছে আমেরিকা ও ইউরোপ এবং অন্য পাশে চীন-রাশিয়া। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমারা বিশ্বের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে এবং এটি বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য অনেক বড় হুমকি।
তবে এর চেয়েও বেশি সমসাময়িক আরেকটি দৃষ্টিকোণ রয়েছে, যা বাদ দেওয়া হচ্ছে: ট্র্যাজেডির মধ্যে একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থার জন্ম, যা রাশিয়া-ইউক্রেনের মতো সংকট প্রতিরোধ ও সমাধানে আরও ভালোভাবে কাজ করবে। কেন? কারণ এটি হবে এমন একটি বিশ্ব, যেখানে আরও সমানভাবে ক্ষমতার ভাগাভাগি থাকবে, যা পশ্চিমের ‘সংকীর্ণ হস্তক্ষেপবাদী স্বার্থ’ দিয়ে পরিচালিত হবে না।
তাদের হস্তক্ষেপের নমুনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেনসহ ২১ শতকের ট্র্যাজেডিগুলোতে। তবে ইউক্রেনের মতো ওইসব জয়গায় ইউরোপীয় ও আমেরিকানদের আন্তরিকতার ঢং প্রকাশ পায়নি। তাদের মানসিকতা একই: পশ্চিমা নেতৃত্বের যুদ্ধগুলো ন্যায্য ও সহনীয়, কারণ এর পেছনে কথিত এক ‘মহৎ মিশন’ রয়েছে।
এই দাবিকে আরও শক্তিশালী করা হয় ফ্যাসিস্ট, কমিউনিস্ট বা ধর্মান্ধদের কাছ থেকে নিপীড়িত জনগণকে মুক্ত করার প্রোপাগান্ডা প্রচারের মাধ্যমে। এটি পশ্চিমা জনগণকে তাদের সরকারের হাতে সংঘটিত নৃশংসতা উপেক্ষা করতে সাহায্য করে। এই ইচ্ছাকৃত অজ্ঞতার সঙ্গে রয়েছে পশ্চিমা জনগণের মনে গভীরভাবে বসে যাওয়া বিশ্বাস, শ্বেতাঙ্গদের জীবন ‘অপ্রীতিকর’ দেশগুলোতে বসবাসকারীদের চেয়ে দামি। রাশিয়া-ইউক্রেন নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোতে এই ভণ্ডামি ও বর্ণবাদ আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
তবে প্রথমবারের মতো সোশ্যাল মিডিয়াসহ যোগাযোগের অন্য প্রযুক্তি মাধ্যমগুলোতে বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে এই প্রতারণা উন্মোচিত হয়েছে। আরব, ভারতীয়, চীনা, আফ্রিকান, দক্ষিণ আমেরিকানদের মাধ্যমে এ বিষয়ে কয়েক হাজার ভিডিও ও বার্তা পৌঁছে গেছে বিশ্বের প্রতিটি কোণে। এটি কয়েকশ বছর ধরে চলা পশ্চিমা প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে লড়তে সাহায্য করছে, যেখানে শ্বেতাঙ্গদের উচ্চতর, দয়ালু, সভ্য ও বিশ্বের স্বাভাবিক নেতা হিসেবে দেখানো হয়।
কেউ অস্বীকার করবে না যে, মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা ভয়াবহ ও অমার্জনীয়। কিন্তু পশ্চিমা মিডিয়া, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের তীব্র প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ার উদ্দেশ্য এবং যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঘটনাগুলো চাপা দেওয়া হচ্ছে। ন্যাটোর সম্প্রসারণ ও উসকানি, ইউক্রেনে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বা রাজনীতিতে শেতাঙ্গ আধিপত্যের সম্পর্ক কী? এই মূল বিষয়গুলো না বুঝলে আমরা শান্তি ফেরাবো কীভাবে?
এছাড়া অন্য সহিংসতাগুলোকেও পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যেমন- ইয়েমেনের কথাই ধরুন। সেখানে সৌদি-নেতৃত্বাধীন নৌ-অবরোধে সমর্থন দিয়েছে মার্কিন নৌবাহিনী। মানবতাবাদী সংগঠনগুলোর দাবি, ইয়েমেনে ৫০ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষে পড়ার অন্যতম প্রধান কারণ এটি। অথচ এ নিয়ে পশ্চিমা এবং বৈশ্বিক মিডিয়াতে তেমন কোনো খবরই নেই। এটিকে মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি সংঘাতের অংশ হিসেবে ‘স্বাভাবিক ঘটনা’ দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে, যেখানে দরিদ্র, অশিক্ষিত মুসলিমরা একে অপরকে হত্যা করছে এবং যুক্তরাষ্ট্র তার কাজে বরাবরের মতোই ন্যায়সঙ্গত।
এখন পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধ তদন্তে ছুটছে, অথচ ইয়েমেন বা যেসব জায়গায় পশ্চিমারা আগ্রাসনকারী, তা নিয়ে কিছুই বলে না।
এতে বৈশ্বিক সংবাদ সংস্থাগুলোর (যাদের বেশিরভাগই পশ্চিমা) দ্বিচারিতাও স্পষ্ট। তারা ইউক্রেনের ক্ষেত্রে জটিল ইস্যুটির পূর্ণাঙ্গ চিত্র ফুটিয়ে তোলার পরিবর্তে পশ্চিমা জনগণের মধ্যে ‘ঐক্যবদ্ধ প্রতিক্রিয়া’ তৈরির চেষ্টা করছে। অথচ ইরাকের ক্ষেত্রে করেছিল ঠিক তার উল্টো। সেখানে অবৈধ আগ্রাসনের কথা না বলে ‘স্বাধীনতা ছড়িয়ে দেওয়ার’ জন্য মার্কিন সৈন্যদের বীর হিসেবে দেখানো হয়েছিল। অথচ পশ্চিমা সেনাবাহিনীর হাতে কয়েক হাজার ইরাকির মৃত্যু ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ কাভারেজ পেয়েছিল একেবারেই সামান্য।
এতে একটি প্রশ্ন সামনে চলে আসে: পশ্চিমারা কেন তাদের মিডিয়ায় যুদ্ধ, বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন নিয়ে যা বলা হয় তা মেনে নেন? হতে পারে, তারা শত্রু পেতে মরিয়া। মনে রাখতে হবে, আমেরিকা স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় ৯৫ শতাংশ সময় কোনো না কোনো যুদ্ধে লিপ্ত, আর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় যুদ্ধগুলোর সূত্রপাত করেছে ইউরোপীয়রা।
ইউক্রেনে ঘটনাবলির প্রতিক্রিয়া বৃহত্তর বিশ্বের কাছে পশ্চিমা শ্রেষ্ঠত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, বিশেষ করে ‘কম দামি’ অ-পশ্চিমা জীবন ও অন্য দেশে হস্তক্ষেপের বিষয়ে। এখন অ-পশ্চিমা দেশগুলো পশ্চিমের ‘বাছাই করা নীতিবোধ’ মেনে নিতে অনিচ্ছুক এবং এটিই সম্ভবত ইউক্রেন ট্র্যাজেডি থেকে উদ্ভূত সবচেয়ে বড় পরিবর্তন।